এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা কি সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর যুক্তিতর্ক সাপেক্ষ। তবে বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় এক দেশ; এটি অনস্বীকার্য। এ দেশের মানুষের প্রাণে ঈমানের ঢেউ দেখে বলতে সাহস হয় এ দেশের মাটি ইসলামি রাজনীতি বা ইসলামি আন্দোলন চর্চার এক উর্বর ভূমি। এ দেশের জন্মের আগ থেকেই ঈমান ও ইসলামের বৃক্ষ রুইয়ে দিয়ে গেছেন ফকির ওলি দরবেশরা। তাদের বদৌলতে সাধারণ জনগণের মনে দীন ধর্মের প্রতি যে আবেগ ভালবাসা পরিলক্ষিত হয় তা দেখে আমাদের কণ্ঠে খেলাফতের আওয়াজ তুলতে ও কালিমার পতাকা হাতে মাঠে নামতে বিন্দু মাত্র ভয় থাকার কথা নয়। এ বিশ্বাসকে বুকে ধারণ করে পূর্বসুরীরা খ-কালীন ইসলামি আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত। কেউ হাফেজ্জি চেতনা বুকে নিয়ে, কেউ আজিজি আদর্শ ধরে, কেউ আমিনি গর্জন মাঠে দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। উলামাদের এ আন্দোলন সময়ে সফলতার মুখ না দেখলেও বাংলাদেশের জন্য তারা হাজার বছরের ইসলামি আন্দোলনের বৈধ দ্বার উম্মোচন করে দিয়ে গেছেন। বাংলার বুকে স্বপ্ন এঁকেছেন খেলাফতের।
পূর্বসূরীদের এ আন্দোলনের পরেও ইসলামি আন্দোলন নিয়ে আমাদের মনে এক চাপা কান্না রয়ে গেছে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বদলিয়ে যাচ্ছে ইসলামি রাজনীতির অবয়ব। ক্রমান্বয়ে উন্নতির সিঁড়িতে আরোহণের বিপরীতে পিছিয়ে পড়ছে ইসলামি দলগুলো। ব্যক্তির মৃত্যুতেও যেন হারিয়ে যাচ্ছে সংগঠন বা আন্দোলন। নতুন কোনো সম্ভাবনার শ্লোগান উঠে না নবীনদের মুখে। রূপ বদলায় না সংগঠনের। জ্বলে উঠা প্রদীপটা যেন ধীরে ধীরে নিভতে শুরু করেছে। এ দুর্বলতা বাংলাদেশ জন্মের ৪৫ বছরেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ইসলামি সংগঠনগুলো। ব্যক্তিকেন্দ্রীক রাজনীতির পূজা করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছি। সুদীর্ঘ মেয়াদি কোনো পরিকল্পনাও নেই কোনো দলের। থাকলেও নেই মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের ধারা। নেতৃত্ব শূন্য মাঠ। নেতৃত্ব তৈরিরও নেই কোনো প্রশিক্ষণ। এরই মাঝে দ্বিধাবিভক্ত মতপার্থক্যের সুর। মতের পার্থক্য ডিঙ্গিয়ে গড়ে উঠে না মত-ঐক্যের দালান। ইসলামি রাজনীতির মাঠে চোখ বুলালে চারদিকে শূন্যতা আর হতাশার দিগন্ত চিত্রায়িত হয়ে ভেসে উঠে। কওম ও মিল্লাতের প্রয়োজন পূরণে নেই কোনো ধারকবাহক বা সংগঠন। যাকে আদর্শের ব্যানার বানিয়ে এগিয়ে যাবে সাধারণ জনতা ও আলেমসমাজ। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও আমাদের হতাশার নি:শ্বাস ফেলতে হয়। শুধুই হতাশা নয়; বিরোধীদের সুকল্পিত ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে অনেকে। জাতীয় সংসদের চেয়ার থেকে, বুদ্ধিজীবিদের পাড়া থেকে ধোয়া উঠে ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধের। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে শ্লোগান উঠে বামদের কণ্ঠে। এগুলোরও নেই কোনো শক্তিশালী প্রতিবাদ। এভাবে চলতে থাকলে ধর্মটা শুধুমাত্র মসজিদ মাদরাসাকেন্দ্রীক আবদ্ধ হয়ে পড়ার আশঙ্কা যে নেই বলা যাচ্ছে না।
রাজনৈতিক অঙ্গনে আলেম উলামাদের প্রভাব বিস্তারের যে ইতিহাস ছিল তাও দিন দিন শূন্যের কোঠায় নামতে শুরু করেছে। দেশ ও জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে ইসলামি দলগুলো। এ ব্যর্থতা যেমন ইসলামি দলগুলোর; এ দায় থেমে মুক্তও নয় মাদরাসাগুলোর কর্তৃপক্ষ। মাদরাসার মিম্বার থেকে দাওয়াত ও তাবলিগের প্রতি যতোটা গুরুত্ব দেয়া হয় ইসলামকে বিজয় বা ইসলামি আন্দোলন যে দীনেরই এক মহান দায়িত্ব এ সবক শিখানো হয় না শিক্ষার্থীদের। ঈমানের শিখায় জ্বালানো হয় না তাগলিবে দীনের বাতি। ইসলামি ঝা-াকে সমুন্নত করার দায়িত্ব কাদের উপর বর্তায় এ প্রশ্নটি আজ পর্দার অন্তরালে রয়ে গেছে। বলা হয়, ছাত্রকালে কিসের রাজনীতি! ছাত্রদের রাজনীতি নেই। রাজনীতি হবে কর্মজীবনে। আসলে রাজনীতি মানে কি? রাজনীতি শব্দটাই হয়তো শিক্ষার্থদের জন্য ভয়ের কারণ। প্রচলিত রাজনীতির কালো মুখোশ দেখে হয়তো রাজনীতির প্রতি মাদরাসাগুলোর অনিহা। মূলত ইসলামি আন্দোলন তো রাজনীতি নয়। রাজনীতির পরিভাষার অন্তরালে ইসলামি আন্দোলনেরই এক মহান কাজ। যেটাকে ছোটো করে দেখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। দীন প্রচারের জন্য যদি শিক্ষার্থীদের তাবলিগে পাঠানো যেতে পারে তাহলে দীন বিজয়ের জন্য কেন শিক্ষার্থীদের পাঠ দেয়া হয় না। সমাজ ও জাতির নেতৃত্বের দীক্ষার কোনো প্রয়োজন কি নেই আমাদের ধারকবাহকদের কাছে?
এ সমস্যাটি খুব সহজ নয়। একদিকে সমাজে জাতির নেতৃত্বের প্রয়োজন যেমন অনস্বীকার্য তেমনিভাবে শিক্ষার গুরুত্বও অপরিসীম। শিক্ষার সাথে যদি নেতৃত তৈরির সমন্বয় ঘটে তাহলে হয়তো সম্ভাবনার একটি দ্বার উম্মোচন হবে। না হয় এক মহা সঙ্কটের বাজনা কড়া নাড়ছে অদূর ভবিষ্যতে। ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা ইসলামি অর্থব্যবস্থার পাঠ যদি না পায় আমাদের শিক্ষার্থীরা তাহলে মসজিদের সুদের বয়ান, রাষ্ট্রে কুফরি আইনের প্রতিবাদের ভাষা হয়তো খুঁজে পাবেন না আমাদের ইমামগণ। সময়ে এ জাতি না জাগলে বাংলাদেশে আলেম উলামারা এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে আর বেশি অপেক্ষা করতে হবে না।