রাষ্ট্র এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা কোন জনপদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানুষের ব্যক্তিগত জীবন,অভ্যাস, রুচি, ধর্মসহ সকল বিষয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। রাষ্ট্র যদি কোন আদর্শ লালন করে থাকে তবে তা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সহজেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আর রাষ্ট্র যদি কোন আদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তবে তা রাষ্ট্রীয় বৈরী আচরণের কারণে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘদিন পরে তা নি:শেষ হয়ে যায়, যার কোন অস্তিত্ব থাকে না। দ্বীনের ক্ষেত্রেও তাই। রাষ্ট্রীয় সমর্থন তথা খেলাফত যদি কোন দ্বীনের অনুকূলে থাকে তবে সে দ্বীন জনপদে প্রতিষ্ঠিত হয়। কোন কারণে যদি দ্বীন রাষ্ট্রের আনুকূল্য হারায় তবে দ্বীনি কার্যক্রম আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে দ্বীনের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। সেজন্য খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রয়োজন পরিমাণ আন্দোলন-সংগাম করা অপরিহার্য।
ইতিহাস সাক্ষি দেয় যখন নববী খেলাফতের ধারা অব্যাহত ছিল তখন দ্বীন প্রতিষ্ঠিত ছিল। আর যখন নববী খেলাফতের ধারা অস্তিত্বহীন হয়ে যায় তখন দ্বীনও প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। আল্লাহর নবী হযরত ঈসা আ. যখন পৃথিবী থেকে উঠে যান তখন থেকে মুহাম্মাদ সা. এর নবুওয়াত প্রাপ্তি পর্যন্ত সময় ছিল ৫৭০ বছর। এ সময় ব্যাপী পৃথিবীতে কোন খলিফা বা নববী খেলাফত ছিল না। ফলশ্রুতিতে ঈসা আ. কর্তৃক আনীত দ্বীন বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। প্রকৃত দ্বীনের আর কোন অস্তিত্ব ছিল না। মানুষ দ্বীন ভুলে গিয়ে মূর্তি পুজায় লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। মানুষের গোমরাহী এত বেশী বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, পবিত্র বাইতুল্লাহর ভিতরে ৩৬০ মূর্তির পুজা হত। জনগণ ওহী ভিত্তিক খেলাফত ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে না থাকায় এমন অমানুষ হয়ে গিয়েছেল যে, কন্যা সন্তান জন্মদানকে লোকলজ্জার কারণ মনে করতো। জীবিত কন্যাকে কবর দিত। সামান্য উটের পানি খাওয়াকে কেন্দ্র করে গোত্রে গোত্রে দন্ধ বেধে যেত এবং তা বংশ পরম্পরায় চলত। এ ধরনের বর্বর জাতিকে সুশৃঙ্খল, সুন্দর, আদর্শ জাতিতে পরিণত করতে ওহী ভিত্তিক খেলাফত শাসন ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থায় সম্ভব না। বাস্তবেও তাই হয়েছিল। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা. যখন পুনরায় নববী খেলাফতের ধারায় কাজ শুরু করলেন এবং পরবর্তীতে মদিনায় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করলেন তখন সেই মানুষ গুলোই সোনার মানুষে পরিণত হয়ে গিয়েিেছল। শত্রু বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল, অসভ্য মানুষ গুলো সারা বিশ্বের জন্য আদর্শ মানুষে পরিণত হয়েছিল। বর্তমানে যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত, হানাহানির এই পৃথিবীতে শান্তি আনয়ন করতে, মানুষ তার প্রভুর অনুগত করে পরকালে স্থায়ী শান্তি পাবার একমাত্র পথ হলো খেলাফত শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
উপরে বর্ণিত ৫৭০ বছর পৃথিবীতে নববী খেলাফতের ধারা অব্যাহত না থাকায় দ্বীন পৃথিবী থেকে প্রায় পুরোপুরি উঠে গিয়েছিল তা একটি হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়। হাদিসটির সারমর্ম নিচে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো- শামসুদ্দীন যাহাবী র.ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত সালমান ফারসী রা. নিজের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, তিনি শাম শহরে একজন রাহেবের নিকট থেকে দ্বীন শিখতেন, যখন রাহেবের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসল তখন তিনি রাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তিনি যদি মারা যান তবে তিনি (সালমান ফারসী রা.) কার কাছ থেকে দ্বীন শিখবেন ? রাহেব উত্তর করলেন শামে ঈসা আ. এর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত আর কেউ নেই। তুমি মোসেল শহরে অমুক ব্যক্তির নিকট যাও, তিনি ঈসাই দ্বীনের উপর আছেন। তিনি মোসেল শহরে গিয়ে সেখানে যে রাহেবের নিকট দ্বীন শিখতেন সে রাহেবও কিছুদিন পর মারা যান। পূর্বের ন্যায় তিনিও সালমান ফারসী রা. কে নছিবাইন শহরে এক রাহেবের সন্ধান দেন। নছিবাইনের রাহেবের ইন্তিকালের পূর্বে তিনি তাকে (সালমান ফারসী-রা.) রোম শহরের ওমোরিয়া গোত্রের এক রাহেবের সন্ধান দেন। রোমের এ রাহেবের মৃত্যুর সময় হযরত সালমান ফারসী রা. যখন পরবর্তী কোন রাহেবের সন্ধান চান তখন সে রাহেব তাকে উত্তর দিলেন “আমি জানিনা এমন কোন ব্যক্তি অবশিষ্ট আছে যিনি আমরা যে ধর্মের উপর আছি সে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন। তবে এখন এমন এক নবীর আগমনের সময় এসেছে যাকে হারামে পাঠানো হবে। তিনি মদিনায় হিজরত করবেন”। (সিয়ারু আ’লা মিন নুবালা-১/১৮৬)
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো রোমের রাহেবের বক্তব্য। তার বক্তব্য অনুযায়ী তখন সত্য দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত আর কেউ ছিলেন না। দ্বীন পৃথিবী থেকে মিটে যাচ্ছিল। তার কারণ হলো নববী খেলাফতের অনুপস্থিতি। এ অবস্থায় যদি সালমান ফারসী রা. এরও ইন্তিকাল হয়ে যেত তবে পৃথিবীতে দ্বীনের সামান্য অস্তিত্বটুকুও বাকি থাকতো না। নবী মুহাম্মাদ সা. যখন পুনরায় কার্যক্রম শুরু করলেন তখন আবার দ্বীন জিন্দা হতে শুরু করল। মদিনায় যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত করলেন তখন চারদিকে দ্বীন বিজয়ের ঢেউ লেগেছিল। বিরোধী কোন শক্তি দ্বীনের মোকাবেলায় টিকতে পারতো না। সুতরাং বুঝা গেল দ্বীনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা, তার সম্প্রসারণ ও বিজয়ের জন্য খেলাফত অপরিহার্য এক উপাদান। তাই খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম-আন্দোলন করা, এর পিছনে জান-মাল খরচ করাও অপরিহার্য।
বর্তমানে দ্বীনের যে অবস্থা , দ্বীন বিরোধী শক্তির যে তৎপরতা তাতে খেলাফত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। চারদিকে ইসলাম ও মুসলমানের অধ:পতন ছাড়া আর কোন খবর পাওয়া যায় না। মুসলিম উম্মাহ ব্যাপক আগ্রাসনের শিকার। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক কূটনৈতিক সকল দিক থেকেই মুসলিম উম্মাহ কোনঠাসা হয়ে আছে। মুসলমানের রক্ত নিয়ে শত্রুরা হুলি খেলছে। যখন ইচ্ছা তখনই মুসলমানকে বোমা মেরে হত্যা করছে।
বানোয়াট অজুহাত দেখিয়ে মুসলমানদের সারা দেশ ধংশের ধার প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। মুসলমানের সম্পদ লুন্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও মুসলমানের নিরাপত্তা নেই। কোন না কোন ভাবে মুসলমান আগ্রাসনের শিকার। একান্ত ব্যক্তিগত কিছু আমল ছাড়া মুসলমান নিশ্চিন্তে ধর্ম চর্চাও করতে পারছে না। মুসলমানের ধর্ম চর্চায় ব্যাপকভাবে নজরদারি চলছে। ওয়াজ মাহফিলের মত সর্বজন গ্রাহ্য দাওয়াতি কাজও সরকারী পারমিশন ছাড়া করা নিষেধ। মসজিদে ইমামদের বয়ানের নজরদারি করার কথা শোনা যাচ্ছে। দ্বীনি মাদ্রাসাগুলো বন্ধের জন্য প্রকাশ্যে তৎপরতা চলছে। সর্বত্র দ্বীনি কার্যক্রম সংকোচিত হওয়ার উপক্রম হয়ে যাচ্ছে। মুসলিম শাসকগণও ইসলাম ও মুসলমানের দ্বীনি উন্নয়নের কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বরং তারা বিজাতীয় অনুকরণ করছে এবং তাদেরই লেজুর বৃত্তি করছে। এমতাবস্থায় শক্তিশালী ইসলামী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। যে সংগঠন আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লবের মাধ্যমে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবে।
একথা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, পৃথিবীতে খেলাফত না থাকলে ক্রমান্বয়ে ইসলাম মুছে যাবে। ভারত, স্পেন, মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন মুসলিম দেশ গুলোতে এক কালে খেলাফত ব্যবস্থা ছিল। তখন ব্যাপক ভাবে ইসলামের সম্প্রসারণ ঘটেছিল । যখনই খেলাফত হাতছাড়া হয়ে গেল তখন শুরু হলো ইসলামের সংকোচনের পালা। সে ধারা এখনো চলমান। এমতাবস্থায় মুসলমান চুপ করে বসে থাকতে পারে না। ইসলামের গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। রাজনীতির ময়দানে তাদের ভূমিকা রাখতে হবে। রাষ্ট্রকে ইসলামের প্রতি অনুগত করতে হবে। রাজনীতি ইসলামের এক অবিচ্ছেদ্য অংঙ্গ। মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ:) বলেন-“রাজনীতি বিহীন ধর্ম অসম্পূর্ণ, পক্ষান্তরে ধর্মবিহীন রাজনীতি ইলহাদ, বেদ্বীনি ও কুফুরী। (হাফেজ্জী হুজুর রহ: রচনা সমগ্র-২৩৮)
তাই আসুন! শক্তিশালী ইসলামী সংগঠন গড়ে তুলি, যে সংগঠন খেলাফত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ রূপে প্রতিষ্ঠিত করবে।
লেখকঃ জনাব মহসিন ভূঞা