আমার বন্ধু ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির নেতা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নামায পড়েন, ধর্মকর্ম করেন। কিন্তু তার ধারণা, রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের প্রয়োজন নাই। ইসলামী রাজনীতির কোন ভূমিকা মানতে তিনি রাজি নন। তার বউ মাথায় কাপড় দেয়। এ জন্যে তার অনেক অহঙ্কার। তিনি একদিন বললেন, আমি তো নামায পড়ি, রোযা রাখি, রমযানে গরীবদের যাকাতের কাপড় দেই। হজও করেছি। এই তো ইসলাম। আপনারা যা বলেন, তা আমার বুঝে আসে না। রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলাম কায়েম এগুলো শ্লোগান হিসাবে মানায়। তিনি মেজাযের মাত্রা নিচে নামিয়ে বললেন, আসলে মনে কিছু নিবেন না। আমি বিষয়টা আপনার কাছে বুঝতে চাই।
এই প্রশ্ন, এমন মনোভাব একা আমার বন্ধুর নয়। সমাজে এমন অনেকে আছেন, যারা সামাজে শ্রদ্ধাভাজন। আমাদের দেশের রাজনীতির মূল ধারাও পরিচালিত হচ্ছে এই মনোভাব পোষণকারী নায়কদের হাতে। কাজেই বিষয়টি নিয়ে ভাবনার যথেষ্ট কারণ আছে।
আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মতকে একটি বিশ্বজনীন দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। কুরআন মজীদের একাধিক আয়াতে বলা হয়েছে : ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম জাতি, মানব জাতির (কল্যাণ সাধনের) উদ্দেশ্যে তোমাদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে। তোমাদের দায়িত্ব হল, তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে আর অসৎকাজে বাধা প্রদান করবে।-(সূরা আলে ইমরান : আয়াত-১০৪)
এ আয়াতের উপর আমল করতে হলে অর্থাৎ বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মাঝে সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে নিষেধের দায়িত্ব পালন করতে হলে অবশ্যই মুসলমানদের হাতে রাষ্ট্রশক্তি থাকতে হবে। কেননা, আদেশ দান ও নিষেধ করা বা বাঁধা দানের কাজ তাদের পক্ষেই করা সম্ভব, যাদের হাতে ক্ষমতা থাকে।
কুরআন মজীদের আরেকটি নির্দেশ হল, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, আর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যকার ‘উলুল আমর’ (ক্ষমতাশীল)-দের। উলুল আমর এর আনুগত্য আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যের মতই ফরয। কাজেই উলুল আমরকে হতে হবে আল্লাহ ও রাসূলের অনুসারী। অন্যকথায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে এমন কাউকে বসাতে হবে, যিনি হবেন আল্লাহ ও রাসূূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একান্ত অনুগত। ইসলামী রাজনীতির মূল কথাও তো এটিই।
হাদীস শরীফে তিনজন মুসলমানও এক জায়গায় বসবাস করলে বা সফর করলে নিজেদের মধ্যে একজনকে আমীর বানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমীর মানে নেতা, সভাপতি, চেয়ারম্যান, প্রেসিডেন্ট, রাষ্ট্রপ্রধান প্রভৃতির যেকোন একটি। দেখুন ইসলামের কোন বিধান সম্মিলিত ব্যবস্থাপনা ও নেতার নেতৃত্ব ও আনুগত্য ছাড়া সম্ভবপর কিনা। তন্মধ্যে নামায, জুমা, ঈদ ও হজ অন্যতম।
সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে বাধা দানের দায়িত্ব পালনের তিনটি স্তর বিন্যস্তকরে দেয়া হয়েছে হাদীসের ভাষায়। এর মধ্যে প্রধান পর্যায় বা স্তরটি হচ্ছে ‘কোন অন্যায় দেখলে হাতে বা শক্তি প্রয়োগে বাধা দাও।’ এ কাজ তারাই করতে পারে, যাদের হাতে রাষ্ট্রীয় নির্বাহী ক্ষমতা আছে। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে না থাকা অবস্থায় শক্তি প্রয়োগে এ কাজ করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। এদেশে সঠিক নেতৃত্বহারা কিছু যুবক এই পার্থক্যটি বুঝতে না পারার কারণে আজ সবাইকে খেসারত দিতে হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন। মক্কায় কাফের মুশরিকদের চরম নির্যাতনের পর মদীনায় হিজরতের পরবর্তী ১০ বছরকে কি বলবেন? এখানে তো তিনি মদীনার ইহুদী খ্রিস্টানদের সঙ্গে চুক্তি করেছেন মদীনা সনদের আওতায়। নিজে বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন, যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন, বিদেশী রাষ্ট্র নায়কদের কাছে পত্র লিখে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। সর্বোপরি ২৭টি যুদ্ধে নিজে সেনাপতি ছিলেন। ৭০ এর অধিক ছোটবড় যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। এতো বিশাল কর্মযজ্ঞকে রাষ্ট্র পরিচালনা বা রাজনীতি না বললে কি বলবেন? এটিই তো সুন্নাত, নবী-ওয়ালা কাজ। সুন্নাত মানে তরিকা অর্থাৎ রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেন তার নামই তো সুন্নাত। আমরা মেসওয়াক পাগড়ির মতো দুই একটি আনুষ্ঠানিকতাকে সুন্নত নামে আখ্যায়িত করি। অথচ সুন্নতের পরিধির মাঝে আছে রাসূলে পাকের সমগ্র জীবন।
রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,তোমরা আমার সুন্নতের অনুসরণ কর আর আমার খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণ কর। সেই সুন্নাত কী? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. হযরত ওমর রা.হযরত উসমান রা.ও হযরত আলী রা.ত্রিশ বছর যে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাই ইসলামের খেলাফত ব্যবস্থার নমুনা, খোলাফায়ে রাশেদীনের অনুসৃত সুন্নাত।এই সুন্নাতকে বাদ দিয়ে বা অস্বীকার করে কেউ যদি নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করতে চায় তাহলে বলার কি আছে।
আপনাকে একটি কথা বুঝতে হবে যে, নামায রোযা হজ যাকাত যেমন ফরয ইবাদত তেমনি ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনাও ফরয ইবাদত। কথাটি বুঝিয়ে বলা দরকার বলে মনে করছি। আমরা নামায, রোযা, হজ, যাকাত কেন পালন করি? নিশ্চয়ই আল্লাহর হুকুম বলে। তাই এসব ইবাদতের পেছনে আমাদের জীবনের মূল্যবান সময় শ্রম অর্থ বিনিয়োগ করি। অথচ কুরআন ও হাদীসে আরো আদেশ আছে যেগুলো আমরা পালন করছি না। যেমন চুরির শাস্তি-হাতকাটা, যেনার শাস্তি-দোররা বা পাথর মেরে মৃত্যুদ- , মদ্যপানের শাস্তি দোররা আর মানুষ হত্যার শাস্তিহত্যার বদলে হত্যা। এক কথায় কুরআনে বর্ণিত ইসলামী দন্ডবিধি। এগুলোর শাস্তিঅনেক কঠিন বিধায় তা প্রয়োগের শর্তাবলিও অনেক কঠিন, যা একমাত্র রাষ্ট্র্রশক্তির মাধ্যমেই প্রয়োগ করা সম্ভব। এসব আমরা পালন করি না বা করতে পারছি না বলে হুকুম রহিত হয়ে যায় নি। বরং এ হুকুম লঙ্ঘনের দায়ে আমরা দায়ী। এই দায়মুক্তির জন্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প পথ আছে কিনা ধর্র্মনিরপেক্ষতাবাদী বন্ধুদের কাছে তার ব্যাখ্যা আমরা চাইতেই পারি।
আমাদের মুসলমানী জীবনের তিনটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ঈমান। মানে আমাদের অন্তরের ধর্র্মবিশ্বাস। এই বিশ্বাস কীভাবে কেমন হওয়া উচিত বা অনুচিত তা যে সাব্জেক্টে আলোচনা হয় তার নাম আকায়েদ। দীর্ঘকাল থেকে দেশের সব দ্বীনি মাদ্রাসায় পাঠ্য আকীদা সম্পর্কিত একটি কিতাবের নাম ‘আকায়েদে নাসাফী’। এই কিতাবের ‘ইমামত’ (নেতৃত্ব) সম্পর্কিত অধ্যায়ের একটি হাদীস হচ্ছে ‘যে ব্যক্তি মারা গেল অথচ তার যমানার ইমামকে চিনলো না, তার মৃত্যু হয়েছে জাহেলিয়াতের উপর।’ আরো বলা হয়েছে ‘মুসলিম সমাজের রাষ্ট্রনেতা নির্বাচন এমন গুরুত্বপূর্ণ ফরয যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওফাত লাভের পর সাহাবায়ে কেরাম তার দাফনের চাইতেও খলিফা নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দেন। সোমবারে নবীজি ইন্তিকাল করেন, মঙ্গলবার খলিফা হিসেবে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.এর হাতে সাধারণ বায়আত অনুষ্ঠিত হয় আর পরদিন বুধবার হযরতের দাফন কাজ সম্পন্ন হয়। এসব কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা হল, ইমাম বা মুসলিম সমাজ ও দেশ পরিচালনার জন্য নেতা নির্বাচন ওয়াজিব।
এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মুসলিম সমাজের অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ ইমাম বা রাষ্ট্রনায়কের উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে জিহাদ বা দুনিয়ার মজলুম মুসলমানদের সহায়তা ও সন্ত্রাসীদের দমনের উদ্দেশে সশস্ত্র লড়াই। এর জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে থাকা অনিবার্য শর্ত।
বললাম রাষ্ট্রনেতা কেবল দুনিয়ার জীবনের শৃঙ্খলা ও সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্যই নয়। আখেরাতে তার প্রয়োজন আরো বেশি। সূরা বনি ইসরাঈলের ৭১ নং আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে, “যেদিন প্রত্যেক মানুষকে তার ইমামসহ আহ্বান করা হবে।” এখানে ইমামের দুটি অর্থ। একটি হচ্ছে নেতা, আরেকটি অর্থ আমলনামা। ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনূদিত কুরআন মজীদে এর অর্থ নেতা। এখন আপনি হিসাব করতে পারেন, আপনি কাকে অনুসরণ করবেন এবং কেয়ামতের দিন অনিবার্যভাবে কার পেছনে বেহেশতে বা দোযখে যাবেন। কাজেই, নেতা, ভোট ও আনুগত্য মোটেও খেলার জিনিস নয়।
একবার তিনি আলেমদের লেবাস পোশাক নিয়ে একটু ব্যঙ্গ করে কি যেন বলতে চাইলেন। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, মানুষ জ্বরাক্রান্ত হলে সুস্বাদু খাবারও তেতো লাগে। দেখুন, আলেমরা সাধারণত যে পাঞ্জাবি পরেন তা তো একটু ভিন্ন রুচিতে আপনিও পরেন। কারণ, তা আমাদের জাতীয় পোশাক । জাতীয় পোশাক কাকে বলে তার সহজ উত্তর, কোন দেশ বা সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজস্ব জাতীয় উৎসব ও অনুষ্ঠানগুলোতে যে পোশাক পরে হাজির হয়, তাকেই বলতে হবে সে জাতির জাতীয় পোশাক । বললাম, চিন্তা করে দেখুন। ঈদে পরবে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আপনি শার্ট পরেন না। পাজামা পাঞ্জাবী না পরলে আপনার অস্বস্তির শেষ থাকে না। চিন্তা করে দেখুন আপনার উৎসবের পোশাকের সাথে আলেমদের পোশাকের মিল আছে কিনা। বললাম, এক গবেষক তো প্রমাণ করেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনে বা কোর্টে মামলা শুনানীকালে যে গাউন ও ক্যাপ অতিথিসহ উচ্চতর ডিগ্রীধারীদের ঐতিহ্যের স্মারক তা আলেমদের জুব্বা ও পাগড়ির ইংলিশ সংস্করণ। অনেকে এই ঐতিহ্যের স্মারকের কথা ভুলে যায় বা অবজ্ঞা করে আর আলেমরা সেই ঐতিহ্য চর্র্চা করে । এতে তো দোষ থাকলে আপনাদেরই আছে।
দেখুন, আলেমরা সারাটা জীবন জ্ঞানের চর্চায় কাটিয়ে দেয়ার পর অনেকের জীবনে এখনো বঞ্চনা। ইসলাম, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে আমরা অনেকে গর্ব করি। যে ইতিহাস না থাকলে মানব জাতির অতীতকাল অন্ধকারে ছেয়ে থাকত; তার ধারাবাহিকতা তো রক্ষা করেছে আলেম সমাজ। যুগে যুগে আলেমদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদান না হলে ইতিহাস বলে লিখিত কোন প্রামান্য পুস্তক থাকতো না, গ্রীক দর্শন আরবীতে তারপর ইংরেজিতে অনুবাদ হতো না, পাশ্চাত্যে জাগরণ আসতো না। স্বয়ং ইসলামী সমাজেও কুরআন হাদীসের চর্চায় আলেমগণ জীবন উৎসর্গ না করলে ইসলাম ও ইসলামী জ্ঞানের কিছুই অবশিষ্ট থাকতো না।
যুগে যুগে আলেম সমাজের জ্ঞানচর্চার ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। উপমহাদেশে প্রায় ৮০০ বছরের মুসলিম শাসনামলে যে শিক্ষাব্যবস্থার আলোকে সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছিল তা ছিল মাদ্রাসা শিক্ষা। ইংরেজি শিক্ষা বা আধুনিক শিক্ষা তো আসে অনেক পরে বৃটিশ শাসন আমলে। ঐ সময়ে স্বয়ং গির্জা শাসিত ইউরোপও ছিল জ্ঞান বিজ্ঞানে অজ্ঞতার অন্ধকারে। মাদ্রাসা শিক্ষার আলোতেই ভারতবর্ষ শিল্প ও স্থাপত্যে উন্নতির শিখরে আরোহন করেছিল, যার কালজয়ী প্রমাণ বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম বিস্ময় তাজমহল। হেকিমী চিকিৎসার ঐশ্বর্যের ধারাবাহিকতা তো এখনো বহন করছে হামদর্দ ও আয়ুর্বেদিক। হাদীস শাস্ত্রের চর্চা ভারতবর্ষে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী রহ.পুনরুজ্জীবন দান করেন, যার আলোতে দুনিয়া এখনো আলোকিত। অর্থনৈতিকভাবেও বিশ্বের এ অঞ্চলটি এতখানি সমৃদ্ধ ছিল যে, ইউরোপীয় বণিকরা সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে বাণিজ্যের লোভে এখানে এসেছিল এবং সুযোগ বুঝে বাংলার মসনদ দখল করে দীর্ঘ দুইশ বছর আমাদেরকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ রেখেছিল। ইতিহাসের এই বাস্তবতাগুলো সামনে আনলে কোন হিংসুকও বলতে পারবে না যে, তখনকার দিনের মুসলিম শাসন কোন দিক থেকে পশ্চাদপদ ছিল কিংবা তখনকার সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক শক্তি মাদ্রাসা শিক্ষায় কোন দিক থেকে অপূর্ণতা ছিল।
ইংরেজ আসার পর ক্ষমতাহারা আলেমদের হাত থেকে ওয়াকফ ও লাখারাজ সম্পত্তির রাষ্ট্রীয় বরাদ্দগুলো কেড়ে নেয়া হয়। কালক্রমে মুসলমানরা দু’বেলা খাবার জুটানোর জন্য সকাল সন্ধ্যা প্রাণান্ত সংগ্রাম চালাতে বাধ্য হয়। ইংরেজ ঐতিহাসিকরাই বলেছেন যে, আগের দিনে মুসলমানদের মধ্যে গরীব ও অশিক্ষিত লোক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল। অথচ ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অল্পদিনের মধ্যেই মুসলমানরা শিক্ষা দীক্ষায় চরমভাবে পিছিয়ে যায় আর অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু ও নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সবচে বড় হুমকির মুখে পড়েছিল নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতির দিক থেকে মুসলমানদের দেউলিয়াত্ব। এই পরিস্থিতিতেই মুসলিম সমাজের সচেতন লোকেরা বিচলিত হয়ে অন্তত দ্বীন ধর্ম রক্ষার তাগিদে মোল্লা মজদুদ্দীন নামক একজন বিজ্ঞ আলেমকে কেন্দ্র করে ইংরেজদের শাসনকেন্দ্র বা রাজধানী কলকাতায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাদের চেষ্টা সফল হলে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা মাদ্রাসা। ইংরেজরা এই শর্তে কলকাতা মাদ্রাসার অনুমতি দেয় যে, এর প্রধান হিসেবে থাকবে কোন ইংরেজ আর শিক্ষা দীক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন একজন আলেম এবং তার পদবী হবে হেড মওলানা। সেই শর্ত অনুযায়ী ১৯২৬ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসা-ই- আলিয়ার প্রিন্সিপালের পদ ইংরেজদের হাতে ছিল। ১৯৪৭ সালে পাক ভারতের স্বাধীনতার সময় মাদ্রাসা আলিয়া ও তার সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ভাগ হয়ে অর্ধেক চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, বর্তমান বকসি বাজারে। মাদ্রাসা আলিয়া ঢাকার সর্বশেষ হেড মওলানা ছিলেন বায়তুল মুকাররামের খতিব মরহুম হযরত মওলানা উবায়দুল হক। তারপরে সেই পদবীটি ভাইস প্রেন্সিপাল হিসেবে পরিবর্তন করা হয়।
উল্লেখ্য যে, ইংরেজদের হাতে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ডুবেছিল ১৭৫৭ সালে আর কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৮১ সালে। আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি না জানার কারণে এক শ্রেণীর মানুষ বলতে চান যে, বৃটিশ সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিল। ধরুন, কোন ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের আমলে কেউ যদি ইসলামের প্রচার প্রসারের উদ্দেশে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে চায় তাহলে অবশ্যই সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে কেউ কি এই বিভ্রান্তি ছড়াতে পারবে যে, ইসলাম বিরোধী সরকার ষড়যন্ত্র করে পত্রিকাটি চালু করেছে।
বস্তুত এই অবস্থা অব্যাহত গতিতে চলছিল এবং কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অনেক শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছিল এই অঞ্চলে। এরি মধ্যে ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা পোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এটি ছিল বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সংস্কৃত ও হিন্দু সংস্কৃতি চালুর সুতিকাগার। রাজ্যহারা মুসলমানরা তখন ইংরেজদের শত্রু জ্ঞান করত এবং ইংরেজি শিক্ষা হারাম ঘোষণা করেছিল।
এর ধারাবাহিকতায় জিহাদের অগ্নিবীণা বেজে উঠেছিল বালাকোটের ময়দানে ১৮৩০ সালে সৈয়দ আহমদ শহীদ রহ.এর নেতৃত্বে। আলেমদের এই সশস্ত্র জিহাদ আপাতত ব্যর্থ হলেও জিহাদের পয়গাম ধুমায়িত হয় উপমহাদেশের আনাচে কানাচে। যার প্রবল শ্রোতে সমগ্র ভারত জুড়ে সংঘটিত হয় সিপাহী বিপ্লব। স্বাধীনতা হারানোর ঠিক একশ বছর পর ১৮৫৭ সালে সংঘটিত সিপাহী বিপ্লবে যোগ দিয়েছিল ইংরেজ সরকারের অধীনস্ত সেনাবাহিনীর মুসলিম সিপাহীরা এবং তাদের সঙ্গে হিন্দু জওয়ানরা। কিন্তু নানা কারণে সে বিপ্লবও ব্যর্থ হয় এবং বিপ্লবী মুসলমানদেরকে বিভিন্ন স্থানে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে দমন করা হয়। যার জীবন্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক ও সেখানে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভ।
তখন আরো একবার অমানিশার ঘনঘটা দেখা দেয় ভারতীয় মুসলমানদের জীবনে। একের পর এক সামরিক ও রাজনৈতিক পরাজয়ের পর জাতিকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার উদ্দেশে বালাকোটের চেতনায় উদ্বুদ্ধ আলেমগণ ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাাসা। শুরু হয় ইসলামী তাহজিব তামাদ্দুনের পুনরুজ্জীবনের নতুন রেনেসাঁ। শুরু থেকেই ইংরেজ সরকার পরিচালিত আলিয়া মাদ্রাসা ও দেওবন্দ মাদ্রাসার মধ্যে কোন বিদ্বেষ বা রেষারেষি ছিল না। যার জ্বলন্ত প্রমাণ, মরহুম মওলানা উবায়দুল হক সহ দেওবন্দ মাদ্রাসা হতে ফারেগ অনেক আলেম জীবনভর আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ও খেদমত করে গেছেন। বলা হয়, বাংলাদেশে তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠায় যিনি সবচে বেশি অবদান রেখেছেন তিনি অর্থাৎ মওলানা আব্দুল আজিজও ছিলেন মাদ্রাসা আলিয়ার ছাত্র।
আলেম সমাজ ও মুসলমানদের উপর ইংরেজদের যখন চরম দমন ও দলন নীতি চলছিল তখন সেই সুযোগে হিন্দুরা ইংরেজদের অধীনে শিক্ষাদীক্ষা , ব্যবসা বাণিজ্য ও সরকারী চাকরি বাকরি লুফে নিতে থাকে। কিন্তু স্যার সৈয়দ আহমদের মত মুসলিম নেতারা বুঝতে পারেন যে, পরিস্থিতির বাস্তবতা বলতে একটি জিনিস আছে। মুসলমানরা এই বাস্তবতাকে বুঝতে না পারলে অচিরেই আরো চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। তারই প্রচেষ্টায় ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আলীগড় মুসলিম স্কুল এবং পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আলেম সমাজের মনেও সংস্কারবাদী মনোভাব চাঙ্গা হয়। তারা জোরালোভাবে বললেন যে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষার সাথে সমন্বয় করতে হবে। সিলেটের মওলানা আবু নসর ওয়াহীদের নেতৃত্বে আলিয়া মাদ্রাসাকে তখন পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে দুইভাবে বিন্যস্তকরা হয়। একটির নাম ওল্ড স্কীম আর অপরটির নাম নিউ স্কীম। নিউ স্কীমে জেনারেল স্কুল কলেজের বইপুস্তক এবং পাশাপাশি মাদ্রাসার কিতাবাদি পড়ানো হত। বর্তমান আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসাগুলোর দিকে তাকালে তখনকার নিউ স্কীমের কথা সহজেই অনুমান করা যায়। তখন বলা হয় যে, মাদ্রাসার উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের জন্য আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।
১৯৪৭ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে তখন নিউস্কীম মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল ১০৭৪টি । তবে এগুলো নামে মাদ্রাসা থাকলেও ভেতরটা স্কুল কলেজে পরিণত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক সরকার এক আদেশ বলে সকল জুনিয়র নিউস্কীম মাদ্রাসাকে হাই স্কুল এবং সিনিয়রগুলোকে ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজে রূপান্তরিত করে দেয়। নমুনা হিসেবে বলা যায়, বর্তমান চট্টগ্রাম মহসিন কলেজ আগে ছিল মোহসেনিয়া মাদ্রাসা, ঢাকার নজরুল কলেজ ও হাম্মাদিয়া হাইস্কুল দুটি ছিল হাই মাদ্রাসা, মাদ্রাসার আকৃতি পাল্টে ভোলার আব্দুর রব হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে ক্রন্দনরত আলেমদের সান্তনার জন্য সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন শাহজাহানের বাবার দেয়া জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বর্তমান ভোলা আলিয়া মাদ্রাসা। রাজশাহী হাই মাদ্রাসা এখনো স্বনামে থাকলেও ভিতরে চলছে স্কুল। বর্ধিত বেতন ভাতার লোভের কবলে পড়ে কলকাতা আলিয়া, সিলেট আলিয়া ও শর্ষীনা আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া বাকি সব মাদ্রাসা তখন নিউস্কীমের টোপ গিলে আত্মহত্যা করেছিল। পরবর্তীতে এই তিন মাদ্রাসা থেকে শাখা প্রশাখা বের হয়ে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসাগুলোর আকাশে আবারো নিউস্কীমের অমানিশা দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে দেওবন্দের সিলেবাসের আদলে গড়ে ওঠা কওমী মাদ্রাসাগুলোর সামনেও নিউস্কীমের হাতছানি এসেছে। এখন কওমী মাদ্রাসার মুরব্বীদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি ইতিহাসকে সামনে রেখে নিজেদের অতীত ও ঐতিহ্যকে ধরে রেখে দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি উদাসীন হয়ে পথ চলবেন? নাকি আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসাগুলোর ন্যায় বারবার আত্মহত্যার অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হবেন। কথাটি অনেকের কাছে কঠিন মনে হতে পারে। এজন্যে একান্ত অনিচ্ছায় লিখছি যে, মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে আমার লেখালেখির বয়স অন্তত চল্লিশ বছর। দেশের পত্রপত্রিকায় আমার যতগুলো প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে যদি সেগুলো এক পাল্লায় রাখা হয় আর অন্যদের লেখা একত্রে এক পাল্লায় রাখা হয় তাহলে আল্লাহ চাহেন তো, আমার লেখাগুলোর পাল্লা ভারি হবে। জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার পতাকায় আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনে আমার ভূমিকার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই না।
আমার ক্ষুদ্র অভিমত হচ্ছে, আধুনিক জ্ঞানের সাথে পরিচিত হওয়া ও চর্চার জন্য এটা শর্ত নয় যে, ছোটবেলা থেকেই বিদেশী ভাষা শিখাতে হবে এবং বিরাট বিরাট বইয়ের বোঝা শিশুকিশোরদের কাঁধে চাপিয়ে দিতে হবে। বরং তাতে ফল হয় উল্টা। কোমলমতি ছেলেমেয়েরা এতবেশি বোঝা বহন করতে পারে না। তাছাড়া আজকের ইংলিশ স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা নিজের অতীত ও ঐতিহ্যের প্রতি উদাসীন হয়ে ফার্মের মুরগি হয়ে গড়ে উঠার মূল কারণ হচ্ছে, শৈশব থেকে ইংরেজিতে তাদের মুখের বুলি ফোটানোর কসরত। মাদ্রাসা শিক্ষার বেলায়ও কথাটি সত্য। হুযুরদের মধ্যে যাদের মনে উর্দু ও ফারসির মায়া বেশি তারা নিচের ক্লাসগুলোতে ছেলেমেয়েদের এসব ভাষা শেখানোর অবৈজ্ঞানিক ও অপরিকল্পিত চেষ্টা চালান। তাদের প্রতি পরামর্শ হল, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করুন এবং উর্দু, ফারসি, ইংরেজি বা অন্য যে কোন ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করুন উচ্চতর ক্লাসে বা একদম শেষে। অনুরূপভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার মূল বিষয়গুলোর উপর শুরু থেকে গুরুত্ব দিয়ে অন্য বিষয়সমূহ উচ্চতর স্তরে শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করতে হবে, মাদ্রাসার পরিভাষায় যাকে ফুনুনাত বলা হয়। পরিশেষে একটি তথ্য দিয়ে আজকের আলোচনার ইতি টানতে চাই।
ইরানে বিপ্লব হয়েছে আজ থেকে ৩৬ বছর আগে ১৯৭৯ সালে। শিয়া আলেমরাই সেখানে এখনো ক্ষমতার দন্ডমুন্ডের মালিক। ইরানের হাওযেয়ে এলমিয়ে বা মাদ্রাসাগুলো এখনো বেসরকারী। এসব মাদ্রাসার যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন আয়াতুল্লারা। এগুলোকে স্কুল কলেজের সাথে একাকার করতে হবে বা বিশ্ববিদ্যালয় মানের সার্টিফিকেট দিতে হবে এমন কথা সেখানে অবান্তর।
আমাদের দেশে যারা আধুনিক শিক্ষা ও দ্বীনি শিক্ষার সমন্বয় চান তারা আলিয়া নেসাবের মাদ্রাসাগুলোতে এসে লেখা পড়া করতে পারে। যারা ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায় তারা জেনারেল লাইনে চলে যাবে। এগুলোও তো আমাদের প্রতিষ্ঠান। এগুলোকে পর ভাবার চিন্তা নিশ্চয়ই ভুল এবং এই ভুল সংশোধন করতে না পারলে গোটা জাতিকে আপন করা ও তাদেরকে ইসলামের সাহায্যকারী হিসেবে পাওয়ার প্রত্যাশা হবে আকাশ কুসুম কল্পনা। যারা দ্বীনের দায়ী ও শরীয়া আইনে বিশেষজ্ঞ হবেন তাদের জন্যই তো মাদ্রাসা শিক্ষা। প্রয়োজনে মাদ্রাসার সংখ্যা কম হোক, তাতে আপত্তি নাই। এদেশে খ্রিস্টানদেরও অনেক সেমিনারি আছে, এগুলো তাদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব অভিজ্ঞতা কাজে না লাগিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিলে পরিণতি হবে মারাত্মক।
‘ইন উরীদু ইল্লাল ইসলাহা; ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ আলাইহি তাওয়াক্কালতু ওয়া ইলাইহি উনীব’।