মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক: উন্নত চিন্তার কারিগর

—————————-

সফলদের সাফল্যগাঁথা পড়তে, জানতে কার ভালো না লাগে। এ নিয়ে আলোচনা হলে শুধু শুনতেই মন চায়। গল্প পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠতে মন চায় না। সবার জানা থাকার কথা সফলতা মানুষের হাতে এমনি এমনি ধরা দেয় না। তাহলে সফল মানুষের তালিকা থেকে কারো নাম বাদ যেতো না। সমাজে সাফল্যের এত কদরও থাকতো না। বরং আল্লাহ তাআলার কুদরতি নেজাম হচ্ছে কর্ম ও অবদানের মাধ্যমে অল্প কিছু মানুষই নিজেদের নাম সফলদের তালিকাভুক্ত করাতে পারে।

সফল মানুষের পরিচয় আমরা অল্প কিছুতেই জেনে যাই। তবে একজন মানুষ অল্পতেই কিন্তু সফল হতে পারে না। সফল হতে হলে পাড়ি দিতে হয় অনেক চড়াই-উৎরাই। নিতে হয় অনেক কিছুর ঝুঁকি। প্রবাদে আছে পরীক্ষা দিলে মানুষের সম্মান বাড়ে বা কমে। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা। পরীক্ষা দিয়ে যে যত বেশি যোগ্য হবে, ঝুঁকি নিয়ে চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করবে এবং সে অনুযায়ী নিজের কর্মপন্থা নির্ধারণ করবে সে তত বেশি সফলতা অর্জন করবে। তাই খ্যাতিমান লোকের সন্তান হয়েও অনেকে অখ্যাত থেকে যায়। আবার অশিক্ষিত, গ্রাম্য ব্যক্তির সন্তানও অনেক সময় বিশ্বকে জয় করে ফেলে। এর পেছনে রহস্য হচ্ছে এগুলোই। কবির ভাষায়-
تقدیر کی پابند نباتات و جمادات
انسان صرف احکام الہی کا ہے پابند
অর্থাৎ ‘তকদিরের হাতে সঁপে দিয়ে বসে থাকা উদ্ভিদ ও জড়বস্তুর কাজ। তকদিরের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের কাজ হতে পারে না। আল্লাহর আইনের ভেতরে থেকে নিজের উৎকর্ষ সাধনের জন্য সবোর্চ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই হচ্ছে সফল মানুষের কাজ।’

সফলতার সংজ্ঞা স্থির কোন বিষয় নয়। সফলতার সংজ্ঞা সময়ে সময়ে বদলায়। শিক্ষাজীবনে ভালো ছাত্র হলে সফল শিক্ষার্থী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কর্মজীবনে এসে ভালো কর্মী হওয়া আর সাংসারিক জীবনে ভালো অভিভাবক হতে পারাকেই ধরে নেয়া হয় সফলতা। ঠিক তেমনি সময়ের ব্যবধানেও সফলতার সংজ্ঞা পরিবর্তন হতে পারে। শিক্ষা উদ্দেশ্যে ভালো মানুষ তৈরি করা। তাই শিক্ষা নিয়ে ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারলেই এক সময় মনে করা হতো সফল মানুষ। অর্থ সম্পদ কতটুকু উপার্জন করতে পারলো দেখার বিষয় ছিলো না। এখন সম্পদ সময় পাল্টেছে । লেখাপড়া শিখে ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারলেও, কামাই রোজগার ভালো না হলে তাকে সফল ধরা হয় না। বর্তমানে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতাও সফলতার সংজ্ঞা থেকে বাদ পড়েছে।

বর্তমান সময়ে আলোকিত ও আলোচিত একজন ব্যক্তি মাওলানা মামুনুল হক। আমরা তার জন্য দোয়া করি ‘হাফিজাহুল্লাহু’। তিনি শুধু কওমী অঙ্গনেই নয় বরং সর্বমহলেই তুমুল জনপ্রিয় ব্যক্তি। জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও বক্তব্যের মাধ্যমে সামনে আসলেও তিনি শুধু একজন বক্তা বা আলোচক নন। তার ব্যক্তিত্বে রয়েছে ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের গুণ। বড় হওয়ার বৈশিষ্ট্য। এগুলোই তাকে যুগের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। এর পাশাপাশি মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক দা.বা. এর মাঝে এমন কিছু গুণ পাওয়া যায়, যা তাকে যুগের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে, পাঠকদের জন্য সেগুলো তুলে ধরলাম।

নেতিবাচক ও তুচ্ছ বিষয় এড়িয়ে চলা

বড় ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তুচ্ছ ও নেতিবাচক বিষয় সচেতনতার সাথে এড়িয়ে যাওয়া। নিজকে বারবার প্রশ্ন করা একজন আদর্শ মানুষের জন্য এগুলোতে জড়ানো উচিত কিনা? বিশেষ করে যারা উম্মতের রাহবার, দ্বীনের দাঈ তাদের মাঝে এই বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য। মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হকের মাঝে এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তিনি ছোটখাটো বিবাদ ও তুচ্ছ বিষয় এড়িয়ে চলার মাঝে মানসিক শান্তি পান। মৌলিক ও বৃহত্তর বিষয় নিয়ে কাজ করতে আগ্ৰহ বোধ করেন। বৃহত্তর স্বার্থে একত্ববাদের বিশ্বাসীদের নিয়ে ঐক্যের পথে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। একারণে বাতিলপস্থিদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করে। কিছু অপরিপক্ক দ্বীনদার বুদ্ধিজীবীর সমালোচনার পাত্রে পরিণত হন।

চিন্তাশীল নেতৃত্ব

বড় কোন কাজ এক ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব নয়। একজনের নেতৃত্ব ও বাকিদের সম্মিলিত চেষ্টায় তা পূর্ণতায় পৌঁছে। নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চিন্তা করতে পারা। আবার বাস্তবতা বিবর্জিত চিন্তা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব না। বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রয়োজন হয় মাঠের কাজ ও চিন্তার সমন্বয়ের। বাংলাদেশে যে ক’জনের নেতৃত্বে এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক তাদের একজন। তিনি একজন চিন্তাশীল ব্যক্তি। তিনি শুধু ফিকির দেন না বরং মাঠেও চষে বেড়ান।

সৃজনশীলতা

সৃজনশীলতা এগিয়ে থাকার অন্যতম মাধ্যম। যে ব্যক্তি সৃজন করতে পারে সে এগিয়ে থাকে। যে এলাকায় সৃজনশীল ব্যক্তিরা থাকেন সেই এলাকাও এগিয়ে যায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পার্থক্যের সীমারেখা এখানেই। পাশ্চাত্যের সবকিছুতে সৃজনশীলতার ছাপ। বিপরীতে প্রাচ্যে রয়েছে অনুকরণের চিত্র। সৃজনশীলতা শিল্প সাহিত্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং তা সর্বত্র। বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতি, সংগঠন, শিক্ষা ও নিজেদের ঐক্যবদ্ধতায় সৃজনশীলতার একটি ধারা তৈরির সম্ভাবনা দেখাতে পেরেছেন মামুনুল হক।

আত্মবিশ্বাস ও আসবাবের সমন্বয়

প্রচলিত সমাজ, সভ্যতার বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে অনেকে আতঙ্কে ভোগেন। কিন্তু বিষয় হচ্ছে ভয়ে জয় নেই। আবার ভয়ের বিষয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার ও অবকাশ নেই। বরং ভয়ের বিষয়কে দূর করার পদক্ষেপ নেয়াও বুদ্ধিমানের কাজ। মামুনুল হকের মাঝে রয়েছে সেই আত্মবিশ্বাস। তিনি বাতিল যত শক্তিশালীই হোক না কেন চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন। অন্যদিকে বাতিলের পক্ষ থেকে বাঁধা বিপত্তির বিষয়গুলোকেও এড়িয়ে যান না। সে লক্ষ্যে ইসলামি শক্তিগুলোর মাঝে ঐক্য সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। কুরআন, সুন্নাহর তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা দ্বারা জনসাধারণের মনেও তিনি জায়গা করে নিচ্ছেন। তাই তিনি আজ পথ চলায় নির্ভীক।

উদ্যমতা ও পদক্ষেপ নেয়া

বড় বড় স্বপ্ন দেখাই সফলদের বৈশিষ্ট্য নয়। স্বপ্ন বড় হওয়া সফলদের আলামত যখন তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া হয়। হ্যাঁ, কেউ পুরোপুরি নিখুঁত নয়। আবার এটাও সত্য কাজের জন্য শতভাগ অনুকূল পরিবেশ কখনো মিলবে না। শতভাগ ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করাও কখনো সম্ভব নয়। সফল তারাই হতে পারে যারা এগুলোর মাঝেই কাজ শুরু করে আস্তে আস্তে টার্গেটের দিকে এগিয়ে যায়। মামুনুল হকের মাঝে আমরা সেই বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই। তিনি এর নমুনা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। আন্দোলনের ময়দানে পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে অখ্যাত কিছু ব্যক্তির সঙ্গে ‘বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস’ এর নামে কাজ শুরু করেছিলেন। সেই বৃক্ষের শাখা আজ সারা দেশে ছড়িয়েছে। তার হাত ধরে যাত্রা শুরু করেছিলো ‘মাহাদূত তারবিয়াতিল ইসলামিয়া’ নামক ছোট্ট একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠান এখন ধীরে ধীরে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

মামুনুল হককে নিয়ে আমাদের চিন্তা বা পেরেশানির কোন কারণ নেই। আল্লাহর রহমতে তিনি আরো বহু দূর এগিয়ে যাবেন। তবে আমরা যারা তার উত্তরসূরি হিসেবে পরিচয় দিতে চাই তাদের কি উত্তরসূরি হওয়ার যোগ্যতা আছে? নিজেকে সে প্রশ্ন করি। কারণ, তিনি নিজেকে নিয়ে উদ্বিগ্ন নন। উদ্বিগ্ন ভবিশ্যত প্রজন্মকে নিয়ে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এই আয়াতের নমুনা হওয়া থেকে হেফাজত করুন- ‘অতঃপর অযোগ্যরা তাদের স্থলাভিষিক্ত হলো, যারা নামাজ নষ্ট করে ফেলে এবং কামনা-বাসনার পেছনে পড়ে থাকে। অতএব ওরা শীঘ্রই গোমরাহীর সম্মুখীন হবে’।

(সূরা মারিয়াম, আয়াত নং-৫৯)

 

মুফতি শহীদুল ইসলাম
সম্পাদক, তথ্য ও গবেষণা বিভাগ
বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস

ফেসবুকে আমরা